বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হচ্ছে-সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভা

বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হচ্ছে-সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভা

সম্প্রতি প্রণয়ন করা গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করছেন গণমাধ্যম সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকরা। তারা বলছেন, এসব আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় স্বাধীন সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এসব আইনের মাধ্যমে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাংবাদিকতায় বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্যমান আইনি কাঠামোগুলো চিহ্নিত করবে সম্পাদক পরিষদ। পাশাপাশি মালিক ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’- শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ। অনুষ্ঠানে সম্পাদক পরিষদের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাংবাদিক সংগঠন ও গণমাধ্যম মালিকরা অংশ নেন। আলোচনায় গণমাধ্যমের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন বক্তারা।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ডিফেমেশন ল’, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট, কনটেম্পট অব কোর্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, গণমাধ্যমকর্মী আইন, ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট ও ওটিটি আইনসহ বেশকিছু আইন রয়েছে যেগুলোর নাম ভিন্ন হলেও প্রয়োগের পরিধি অভিন্ন। এগুলো প্রয়োগে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে

বিজ্ঞাপন

তিনি প্রশ্ন রাখেন- আমরা এমন কী করি এত আইন করে আমাদের হাত-পা বেঁধে দিতে হবে? ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নিতে হবে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে অপরাধ সংক্রান্ত ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টিই জামিন অযোগ্য। সাংবাদিকরা এমন কী অপরাধ করে যে, তাদের জামিন করা যাবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতা বিকশিত হওয়ার পথে অন্তরায় এই আইন। আইনটি তৈরির সময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল একটি লাইন যুক্ত করতে যে, আইনটি গণমাধ্যমের ওপর প্রয়োগ হবে না। শুধুমাত্র ডিজিটাল অপরাধের জন্য প্রযোজ্য হবে।
গণমাধ্যমকর্মী আইন নামে একটি আইন করা হয়েছে যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাংবাদিকবান্ধব আইন। কিন্তু এই আইনে গণমাধ্যম আদালত, আপিল আদালতের কার্যক্রম যুক্ত করে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সেল্ফ সেন্সরশিপ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ‘ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’- এটা আমি বিশ্বাসই করি না। কারণ অ্যাকশন যেখানে শুরু হয়ে গেছে, মামলা হচ্ছে, অ্যারেস্ট হচ্ছে সেখানে আমরা নজরদারির কথা বলছি কেন? আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তিনবার অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হয়েছে। এরশাদের জমানায় জেলে গিয়েছি, খালেদা জিয়ার আমলে জেলখানায় গিয়েছি। আর এই আমলে ৮ মাস দেশের বাইরে ছিলাম। এখন দেখছি আইন লাগে না, সেখানে নতুন আইনের কী প্রয়োজন। প্রচলিত আইনই প্রয়োগ করা হয়েছে বারবার।
তিনি বলেন, মালিকদের নয়, সমস্যা সাংবাদিকদের মধ্যে। কোনো রিপোর্টারদের হাতে রিপোর্ট আসলে সম্পাদকের কাছে দেয়ার আগেই তারা কিল করে বসে থাকেন। অথবা কোন রিপোর্ট যাচ্ছে, তারা রিকোয়েস্ট করেন এটা না দিলে কেমন হয়।

তিনি বলেন, এই অবস্থায় আমাদের সম্মিলিতভাবে অবস্থান নিতে হবে। একা সেটা সম্ভব নয়। বিভাজন থাকলে কোনো অবস্থাতেই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। বিভাজন কেন হলো, কারা করলো অনেক বছর থেকে এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এই বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনটি প্রণয়নের সময় আমরা ১৩/১৪টি ধারা নিয়ে সমস্যার কথা বলেছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এখানে ৫৭ ধারা থাকবে না। আইনটি সংসদে উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী বলেছিলেন এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার সারা জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আইনমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, সাংবাদিকদের ওপর আইনটি প্রয়োগ হবে না। যদি কোনো কারণে প্রয়োগ হয় তবে তিনি আইনজীবী হিসেবে বিনা পয়সায় সাংবাদিকদের পক্ষে লড়বেন। কিন্তু কোথায় আইনজীবী আর কোথায় মন্ত্রী- আমরা খুঁজে পাইনি।

সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও নিউএইজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছি সেটা শতভাগ রাজনৈতিক সমস্যা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশের মানুষ যখনই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে কোনো সরকারই কোনো সময়ই তা সহজে হতে দেয়নি। যখনই কোনো সরকার কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে তখন যে বিষয়গুলোর ওপর আক্রমণ করে বসে সেটি হচ্ছে সংবাদপত্র। যখন কোনো সমাজে মিডিয়ার ওপর নিপীড়ন হচ্ছে, মিডিয়া কর্মীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে কিংবা ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে-সেটা যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সমাজে গণতন্ত্রের ঘাটতি সেই পরিমাণ হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু সাংবাদিকদের প্রয়োজন নয়, জনসাধারণেরও প্রয়োজন রয়েছে।

সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, পেছন থেকে কেউ নজরদারি করলে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করা যায় না। মুক্তবুদ্ধি, মুক্ত চিন্তা, মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য যে সংস্কৃতি দরকার সেটি বাংলাদেশে আছে কিনা, বাস্তবে আছে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের সংকটে সুশীল সমাজ পাশে থাকে না। কারণ আমরা দুটো আলাদা আলাদা সুশীল সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করি। তাহলে আমাদের সংকটে কেন তারা পাশে দাঁড়াবে। গণতন্ত্রের জন্য বড় প্রয়োজন মুক্ত সাংবাদিকতা।

নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন-নোয়াব সভাপতি একে আজাদ বলেন, সংবাদপত্রের বিকাশে সাহসী নেতৃত্ব জরুরি। ৬০/৭০/৮০-এর দশকে সাংবাদিকদের মধ্যে যে নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, দক্ষ ও সাহসী সাংবাদিক পাওয়া গিয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই না। মালিক, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও সম্পাদকরা একত্রিত হলে আমরা সকলকে আমাদের সমস্যাগুলো বোঝাতে সক্ষম হবো।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না। সব সরকারই গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।
বিএফইউজে’র একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি এখন বড় সমস্যা। একই নামে সংগঠন কিন্তু সভাপতি দুই জন। এই বিভক্তির অবসান দরকার।

ডিইউজে’র একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, আইন হয় মানুষের কল্যাণে, রাষ্ট্রের কল্যাণে। কিন্তু আমাদের দেশে আইন হচ্ছে মানুষের কন্ঠরোধ করার জন্য। রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটির ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাকেও সেই উচ্চতায় নিতে হবে। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- বিএফইউজে’র একাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ, ডিইউজে’র একাংশের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ।

Related Articles