পদ্মা সেতু: যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর সেতুর ওপর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার হিড়িক

পদ্মা সেতু: যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর সেতুর ওপর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার হিড়িক

উদ্বোধনের একদিন পর রবিবার ভোর থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে পদ্মা সেতু। এরপর থেকেই সেতুর উপর দিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান যানবাহনের চাপে মাওয়া প্রান্তে যানজট তৈরি হয়।

দুপুর পর্যন্ত বহু মানুষকে সেতুর উপর গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে এবং ভিডিও করতে দেখা যায়।

সংবাদদাতা নাগিব বাহার জানাচ্ছেন, বহু মানুষ সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত যানবাহন থামিয়ে নেমে পড়ছিল।

পুলিশের টহল ভ্যান এসে তাদের সরিয়ে দিলেও আবার কিছুক্ষণ পরেই একই অবস্থা তৈরি হচ্ছিল।

এমনকি পুলিশের বাধা অমান্য করে বহু মানুষকে পায়ে হেঁটে সেতুর উপর উঠে পড়তে দেখা যায়।

এরকম একজনের সাথে কথা হয়েছে বিবিসির সংবাদদাতার। তিনি বলেন, তাকে এক দফা সেনাবাহিনীর সদস্যরা আটকে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার সেতুর উপর উঠে পড়েন।

তিনি বলছিলেন, তার স্বপ্ন পদ্মা সেতু হেঁটে পার হওয়ার। তিনি শরিয়তপুরের জাজিরার প্রান্ত থেকে উঠে পদ্মা সেতু দিয়ে হেঁটে মাওয়া প্রান্তে এসে আবার হেঁটেই জাজিরা প্রান্তে ফেরত গেছেন।

পুলিশ বলছে, তারা বাধা দেয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করছে।

কিন্তু এত মানুষ এসে উঠে পড়ছে যে তাদের সবাইকে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। বিবিসিকে বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান।

ভোরবেলা মাওয়া প্রান্তে যানজট:

সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, ভোর ছটার কিছু আগে যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়ার পর সেতুর মাওয়া প্রান্তে যানজট সৃষ্টি হয়।

মুন্সীগঞ্জের সাংবাদিক মীর নাসিরউদ্দীন উজ্জ্বল জানাচ্ছেন, টোল প্লাজায় এক একটি যানবাহনের টোল আদায় করতে যে সময় লাগছে, তার তুলনায় যানবাহনের চাপ অনেক বেশি হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এছাড়া প্রথম দিন সেতু পার হতে আগ্রহীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়াও যানজটের একটা কারণ বলে উল্লেখ করছিলেন তিনি।

অনেকেই প্রথমবার সেতুতে উঠবার জন্য ভোররাত থেকেই মাওয়া প্রান্তে এসে অপেক্ষা করছিলেন। ফলে সেতু খুলে দেয়ার সাথে সাথে যে যানজট হয় সেটা ছিল তীর্ব্র। পরে অবশ্য তীর্ব্রতা কমে আসে যানজটের। কিন্তু কমবেশি যানজট দুপুর পর্যন্ত দেখা গেছে।

বিবিসির সংবাদদাতা নাগিব বাহার সকালে মাওয়া গেছেন। তিনি সেতু পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

নাগিব বাহার বলছেন, তার সামনে এক কিলোমিটারের মত দীর্ঘ যানজট রয়েছে।

তবে খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়িগুলো।

তিনি আশা করছেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে টোল প্লাজায় পৌঁছে যাবেন।

মীর নাসিরউদ্দীন উজ্জ্বল টোল প্লাজা এলাকা থেকে বলছিলেন, এক একটি গাড়ির টোল আদায় করতে দু-তিন মিনিটের মত লাগছে। মোট ছটা বুথ থেকে টোল আদায় করা হলেও, যানবাহনের চাপ অত্যধিক হওয়ায় এই যানজট তৈরি হয়েছে।

তবে তিনি বলছিলেন, পদ্মা সেতু প্রথমবারের মত পার হওয়া নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস এত বেশি যে যানজট নিয়ে খুব বেশি অভিযোগ তার চোখে পড়েনি।

নাগিব বাহারও বলছেন, যানজট থাকলেও তা নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব একটা আক্ষেপ চোখে পড়ছে না তার।

এক দম্পতির সাথে কথা বলেছেন তিনি, যারা যানজট দেখে বাস থেকে নেমে সেতু অভিমুখে হাঁটা শুরু করেছেন।

এই দম্পতির বাড়ি নদীর ঠিক ওপারে শরীয়তপুরে।

তারা বলছিলেন, তারা মূলত প্রথম দিন সেতু পার হওয়ার জন্যই এসেছেন।

“সারা জীবন এখান থেকে ফেরি পার হয়েছি। যখন সেতু তৈরি হচ্ছিল তখনও বিশ্বাস হয়নি, কোনদিন এই সেতু পার হতে পারবো। তাই নিজের অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজ এসেছি” – বলছিলেন তারা।

সেতু পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকা আরেকজন বাসযাত্রী বলছিলেন, ‘পদ্মা নদীকেও যে বশে আনা যায়’ সেটা তার বিশ্বাস করতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।

ভোর ছটা থেকে যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়ার কথা থাকলেও দশ মিনিট আগেই যানবাহন চলতে শুরু করে সেতুর উপর দিয়ে।

বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে তৈরি ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সংযোগ তৈরি করেছে।

শনিবার এই সেতু উদ্বোধনের পর প্রথম টোল দিয়ে সেতু পার হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে এদিন সারাদিনই সেতু যান চলাচলের জন্য বন্ধ রাখা হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে।

এদিন ফেরিও বন্ধ রাখা হয়।

ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে এই রুট দিয়ে সড়কপথে যোগাযোগ কার্যত অচল ছিল এই রুট দিয়ে।

কোন গাড়িতে কতো টোল দিতে হবে?

পদ্মা সেতুর উপর যাতায়াতকারী যানবাহনের টোলের হার আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা অনুযায়ী টোলের হার:

মোটরসাইকেল – ১০০ টাকা
কার ও জিপ – ৭৫০ টাকা
মাঝারি বাস – ২০০০ টাকা
বড় বাস – ২,৪০০ টাকা
মাইক্রোবাস – ১,৩০০ টাকা
মিনিবাস – ১,৪০০ টাকা
ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) – ১,৬০০ টাকা
মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) – ২,১০০ টাকা
মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) – ২,৮০০ টাকা
বড় ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) – ৫,৫০০ টাকা
ট্রেইলার – ৬,০০০ টাকা

গত মে মাসে যখন এই টোলের প্রস্তাব করা হয়, তখন এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।

অনেকেই ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।

অনেকে যমুনা সেতুর সঙ্গে টোলের হারের পার্থক্য তুলে ধরেন।

ফেরিও চালু রাখা হয়েছে:

শনিবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কারণে নিরাপত্তা ইস্যুতে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হলেও রবিবার সেতুর পাশাপাশি ফেরিও চালু রাখা হয়েছে কয়েকটি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন আগেই জানিয়ে রেখেছে, পদ্মা সেতু চালু হলেও শিমুলিয়া ঘাট থেকে সীমিত আকারে ফেরি চলাচল অব্যাহত থাকবে।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী বিবিসি বাংলাকে গত মে মাসে বলেছিলেন, ”সেতু চালু হলেও সেখানে ফেরি চলাচল একেবারে বন্ধ হবে না। বিকল্প বা জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ঘাট থাকবে। সেই সঙ্গে আমরা দুইটি ফেরি চালানোর কথা ভাবছি। খুব ভারী যেসব যানবাহন আছে, সেগুলো পদ্মা সেতুর বদলে ফেরি দিয়ে চলাচল করতে পারবে।”

পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া রুটের ফেরি চলাচল এখনকার মতো অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ফেরির টোলও বাড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে ফেরির যে টোল হার রয়েছে, তার ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ”একটি ভালো সময় দেখে আমরা নতুন টোল হার কার্যকরের ঘোষণা দেবো। বর্তমানে যেখানে যে ফেরির টোল যা রয়েছে, তা থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে।”

এখন পর্যন্ত শিমুলিয়া ঘাট অথবা পাটুরিয়া ঘাট থেকে ফেরিতে করে পার হতে একটি কার বা জিপকে ৫০০ টাকা টোল দিতে হয়।

নতুন টোল হার নির্ধারিত হলে সেখানে ৫৯০ অথবা ৬০০ টাকা হতে পারে।

পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু তথ্য:

* পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন রয়েছে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের সেতু এটি, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।

* পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য নয় কিলোমিটারের বেশি।

* দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।

* সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। রেল চলাচল করতে সময় লাগবে আরো।

* পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।

#বিবিসি

Related Articles