দেশপ্রেমিক কখন যে দেশদ্রোহী হয়ে যায়….

দেশপ্রেমিক কখন যে দেশদ্রোহী হয়ে যায়….

আমার প্রিয় কবিতার একটি রবার্ট ব্রাউনের লেখা দ্য প্যাট্রিয়ট। এতে একজন রাষ্ট্রনেতার, একজন দেশনেতার স্বরূপ ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে কবিতাটি মনে পড়ছে শ্রীলঙ্কার পালানো ভিরু প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের জন্য। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে কবিতাটি আমাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে একটি লাইন ব্যাখ্যা হিসেবে পরীক্ষায় আসতো- ‘দাজ আই এন্টারড অ্যান্ড দাজ আই গো!’ এতদিন পর কেন যেন মনে হচ্ছে, কবিতাটি রাজাপাকসেদের মতো শাসকদের জন্যই লিখেছেন রবার্ট ব্রাউন। চমৎকার নাটকীয়তায় ভরা দ্য প্যাট্রিয়ট। দেশপ্রেমিক ও জাতীয় বীরদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনের পরিবর্তনশীলতা চমৎকারভাবে এই কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। নেতা যখন ক্ষমতায় আসেন তার প্রতি জনগণের প্রত্যাশা থাকে অসীম। জনগণ তাকে সর্বোচ্চ শিখরে স্থান দিতে পারে। আকাশের চাঁদটা পর্যন্ত এনে দিতে পারতো, যদি সাধ্যে কুলাতো।

দেশপ্রেমিক যখন শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, তখন চারদিক থেকে পুষ্পবৃষ্টি হয়। সারাপথে বিছানো থাকে গোলাপ। চার্চের চূড়ায় চূড়ায় শোনা যায় বিজয়ধ্বনি। বিজয় ঘন্টার অবিমিশ্র শব্দে ভেঙে পড়ে বাতাস। জনতার ভিড়, আর্তআনন্দ চিৎকার জাগিয়ে তোলে শহরের এঁটো পুরনো দেয়াল। জেগে যায় তা। সামিল হয় এই অভিবাদন উল্লাসে। তাদের তরুণমনের আকাশ থেকে সূর্য্যটা চেয়ে বসেন দেশপ্রেমিক। জবাবে তারা বলে- তারপর? তারপর বলো আর কি চাও? ভাবখানা এমন অবারিত সব। যা চাইবেন দেশপ্রেমিক, তাই দিয়ে দেবে জনতা। অতঃপর সূর্য্যরে দিকে ঝাঁপ দেন দেশপ্রেমিক। তিনিও তার দেশবাসীকে প্রাণ অফুরান দেয়ার চেষ্টা করেন।
কিন্তু এক বছর পরে উন্মাদনায় মেতে থাকা সেই জনতা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। দেশপ্রেমিকের কৃতকর্মের জন্য। তার অপরাধের জন্য। তাকে পেছনে হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। তার জন্য নিজের কলিজা ছিড়ে দেয়া সেই জনতা নেই পথে। সেই বাড়িগুলোর ছাদ ফাঁকা। নেই কোনো পুষ্পবৃষ্টি। উল্টো পাথর ছোড়া হয় তার দিকে। তাতে রক্তাক্ত হন সেই দেশপ্রেমিক। সেই মানুষ আর তাকে ভালবাসে না। তারাই তার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হন। কবিতাটির শুরু থেকে শেষ- পুরোটাই যেন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে আর তার বড়ভাই মাহিন্দ রাজাপাকসেদের জন্য লেখা। ক্ষমতার দম্ভ তাদেরকে অন্ধ করে তুলেছিল। তারা জনগণের পালস বুঝতে পারেননি অথবা পারলেও ভেবেছেন রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের, কে ঠেকায়! তারা এই দ্য প্যাট্রিয়ট জীবনে পড়েছেন কিনা জানি না। তাদের নির্দেশে বাহিনীপ্রধানরা উঠতে-বসতে বাধ্য। তাদের নির্দেশে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। আইন নড়ে, ফাইল চলে। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, অসীম ক্ষমতার মালিক তারা। এখান থেকে কোনোদিন নামতে হবে না। কিন্তু দিনশেষে নির্যাতনকারী, জুলুমবাজ, প্রতারণাকারী যেকোনো শাসকেরই এমন পরিণতি ঘটে। তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ দিয়ে গেলেন রাজাপাকসেরা।

শেষে পালালেন। পালালেন তো এমনভাবে যে, চোরও এভাবে পালায় না। সবচেয়ে নিকৃষ্ঠ হয়ে, সবচেয়ে ধিকৃত হয়ে পালালেন তিনি। যদি জনতার হাতে ধরা পড়তেন, একবার কল্পনা করুন, পরিণতি কি হতো! একজন গৃহহারা মানুষের মতো, একজন নিঃস্ব মানুষের মতো এদেশ ওদেশের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের মতো আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন প্রেসিডেন্ট। প্রতিবেশী ভারত, যাকে ভাবা হয় রাজাপাকসেদের ঘনিষ্ঠতম হিসেবে, তারা পর্যন্ত তাকে আশ্রয় দেয়নি। তিনি সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির ঢেউয়ের ওপর ভেসেছেন। কোনো স্থলভাগের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। ভাবুন কেমন ছিলেন তিনি। তাকে আশ্রয় দেয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে ওখানে আশ্রয় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তার সুপারিশে মালদ্বীপ তাকে আশ্রয় দেয়ার আবেদন গ্রহণ করেছে। তাই তিনি চোরের মতো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছেন সেখানে।

তামিলদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তিনি অভিযুক্ত। বার বারই তার সরকার এমন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু দুনিয়ার চোখ, জনতার চোখকে তো বন্ধ করে রাখা যায় না। ক্ষমতার জোরে তিনি এবং তারা সত্যকে মিথ্যার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে চেয়েছেন। যখন দেশের মানুষ অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য জীবন-মরণ সংগ্রাম করছে, তখন তার রাজপ্রাসাদে পাওয়া যায় লাখ লাখ রুপি। তাহলে তিনি কোন জনগণের সেবক, কেমন দেশপ্রেমিক? অত্যাচারকারী শাসক, নির্যাতনকারী শাসক, মুখ বন্ধ করিয়ে দেয়া শাসকদের পরিণতি কি হয়, তা যেন প্রামাণ্যচিত্রে রূপ দান করে গেলেন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। কিন্তু এ থেকে কি কোনো শাসক শিক্ষা নেবে? জনগণের দুর্দশার দিকে দৃষ্টি দেবে? একের পর এক চাপিয়ে দেয়া নীতি, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনও তারা বলে যান- জনগণ সুখেই আছে। শান্তিতে আছে। দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠী কি এ থেকে কোনোও শিক্ষা নেবে?

Related Articles