এ,টি,এম,তোহা : চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ছেলের গুলিতে মায়ের মৃত্যুর ঘটনার পর পালিয়ে থাকা ছেলেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। পুলিশ বলছে পারিবারিক কলহের জেরে এই হত্যাকাণ্ড।
ঘটনার একদিন পর পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাব তাকে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে গ্রেফতার করেছে। মঙ্গলবার দুপুরে পটিয়া উপজেলা সদরের সবজার পাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতে ছেলের গুলিতে নিহত হন জেসমিন আক্তার।
তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং পটিয়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলমের স্ত্রী। মাত্র গত মাসেই মারা গেছেন শামসুল আলম।
যা ঘটেছিল সেদিন
ঘটনাটি ঘটেছিল একমাত্র মেয়ে শায়লা শারমিনের সামনে।
তিনি বলেন, “আমার দিকেই প্রথমে পিস্তল তাক করেছিল। কিন্তু সেই গুলিটা ফোটেনি। মাটিতে পড়ে গেছে। তারপরই সে আবার পিস্তল তাক করে এবং আম্মুর চোখে এসে গুলিটা লাগে।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন শায়লা শারমিন।
“সে যখন দুপুর দেড়টার দিকে বাসায় ঢোকে তখনই সে ক্ষিপ্ত ছিল। আমি চাইনি আমার বাচ্চাটা তার এসব চেঁচামেচি দেখুক। সেজন্য মেয়েকে কাজের লোকের সাথে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ও যে কোমরে গুঁজে পিস্তল নিয়ে এসেছে সেটা ঘুণাক্ষরেও আমার মাথায় ছিল না,” বলছিলেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী শায়লা শারমিন বলছিলেন, মৃত জেসমিন আক্তারকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিসার প্রক্রিয়া চলছিল।
এর আগেও তিনি মেয়ের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থেকেছেন কিন্তু এবার পুরোপুরি মাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলেটিও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছে।
মাইনুল ইসলাম কিছুদিন আগেই প্রেম করে বিয়ে করেছেন এবং অনুষ্ঠান করে স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেনিয়েও পরিবারের সাথে তার বিবাদ ছিল বলে পুলিশ বলছে।
ঘটনা নিয়ে পুলিশ যা বলছে
পটিয়া থানায় ছোট ভাই মাইনুল ইসলামের বিরুদ্ধে শায়লা শারমিনের দায়ের করা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: রেজাউল করিম মজুমদার জানান, ব্যাংকে মৃত শামসুল আলমের রেখে যাওয়া অর্থ নিয়ে ঘটনার দিন মা ও বোনের সাথে বাদানুবাদ হয়েছিল পরিবারের মেজো সন্তান মাইনুল ইসলামের।
মি. আলমের মৃত্যুর পর থেকেই তাদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ চলছিল বলে জানান মি. মজুমদার।
“ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা রাখা ছিল যার নমিনি ছিল মা এবং ১৩ লাখ টাকার একটা এফডিআরের নমিনি ছিল বোন। তার মা এবং বোন সেদিন ব্যাংকে গিয়েছিল এই টাকাটা কোন প্রক্রিয়ার তারা তুলবেন সেব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য। সে খবর পেয়েছে যে মা ও বোন মিলে টাকাগুলো তুলে নিয়ে এসেছে। টাকা নিয়ে তারা অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। এটা শুনে সে বাসায় আসে এবং ঝগড়ার এক পর্যায়ে গুলি করে দেয়।
“প্রথম গুলিটা মিস ফায়ার করেছে বলে বোনটি বেঁচে গেছে। এরপর সে আবার পিস্তল ঠিক করে মায়ের দিকে গুলি করে। গুলিটা গিয়ে মায়ের চোখের নিচের দিকে গিয়ে লাগে,” বলছিলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পুলিশ বলছে পারিবারিক কলহের জেরে এই হত্যাকাণ্ড।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। ব্যবহৃত অস্ত্রটির লাইসেন্স ছিল না বলে জানিয়েছেন তিনি।
যেভাবে গ্রেফতার করা হল ছেলেকে
র্যাব সাতের কমান্ডার লেফটেনেন্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ জানান, গ্রেফতার মাইনুল ইসলামের নামে অস্ত্র মামলাসহ এর আগেই আরও আটটি মামলা রয়েছে।
মাইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করতেন এবং কোন পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন না।
তার ভাষায়, “নেশা ও আচরণগত সমস্যার কারণে বাবা-মা বা পরিবারের কেউই তার উপর সন্তুষ্ট ছিল না। হয়ত এই কারণে বাবা বেঁচে থাকাকালীন তাকে নমিনি করেনি। পরিবারের সাথে কথা বলে আমাদের এরকম মনে হয়েছে।”
কীভাবে মাইনুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হল তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, “ঘটনার পর প্রথমে সে অস্ত্রটা লুকিয়ে দোহাজারিতে গিয়ে পালিয়েছিল।
“গতকাল সে বাসে করে ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আমাদের কাছে থাকা খবর অনুযায়ী আমরা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ঢাকাগামী ওই বাসটি থামাই। বাস যাত্রা শুরু করার পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অজ্ঞাত বড় ভাইয়ের আশ্রয়ে ছিল ২দিন
পটিয়ায় মাকে হত্যা করে ২ দিন এক বড় ভাইয়ের আশ্রয়ে চন্দনাইশের দোহাজারী এলাকায় এক কারখানায় আশ্রয় নেয় হত্যাকারী মাঈনুদ্দিন মো: মাঈনু। সেখান থেকে গতকাল ঢাকাগামী একটি বাসে করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ চন্দনাইশ থেকে তাকে আটক করে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ অগাস্ট) দুপুরে র্যাব-৭ এর সিপিসি-৩ বহদ্দার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে: কর্নেল এম এ ইউসুফি পিএসসি।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে আবেগাপ্লুত র্যাব অধিনায়ক বলেন, পিতা-মাতার সাথে সন্তানের যে পবিত্র সম্পর্ক সে সম্পর্কের মধ্যে একজন সন্তান যখন তার মাকে হত্যা করে তখন যে কোন বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। গত ১৬ অগাস্ট পারিবারিক বিরোধে পটিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্ষিয়ান রাজনীতিক শামসুল আলম মাস্টারের বড় ছেলে তার অস্ট্রেলিয়া প্রাবাসী মাকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের পরও হত্যাকারী মাঈনুলের মধ্যে কোন অনুশোচনা ছিল না। সে তার মোবাইল পানিতে ফেলে দেয় এবং কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘুরতে থাকে। এক পর্যায়ে ঐ দিন বিকেলে সে তার কথিত এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে দোহাজারীতে আশ্রয় নেয় এবং সাথে থাকা পিস্তল একটি গুদাম ঘরের মালপত্রের নিচে লুকিয়ে রাখে। পরদিন ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সে ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার জন্য ঢাকাগামী একটি বাসে বিনা টিকেটে উঠে পড়ে। যাতে কেউ তার অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে। কিন্ত হত্যাকান্ডের পর র্যাবের গোয়েন্দাদল ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪টি মামলার তথ্য পেলেও পরিবার থেকে জানানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ৭/৮টি মামলা রয়েছে। ঘটনার নেপথ্যের কারণ বর্ননা করতে গিয়ে র্যাবের অধিনায়ক জানিয়েছেন, ছোটকাল থেকেই মাঈনুল ছিল উচ্ছৃংখল প্রকৃতির । মাদকাসক্ত ছাড়াও নানান অপরাধে সে জড়িত হওয়ায় তার পিতা জীবদ্দশায় বেশির ভাগ ধন-সম্পত্তি তার মা ও বোনের নামে লিখে দিয়ে যান। এতে পরিবারের প্রতি সে আরো প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে পড়ে।
পিস্তলটি কার ? এই প্রশ্নের উত্তরে র্যাব জানায়, প্রাথমিক তদন্তে পিস্তলটি তার পিতার ড্রয়ারে পেয়েছে বলে সে জানায় এবং সেটি লাইসেন্স করা। তবে এটি এখনো যাচাই করে দেখা হয়নি। ২০১৩ সালে প্রথম তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর সে আর পড়াশোনা করেনি। এক পর্যায়ে তাকে তার পরিবার ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেন। সেখানেও সে আইন ভঙ্গ করায় তার ভিসা বাতিল হয়। ২০১৯ সালে সে দেশে ফিরে আসে আবারো নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। গত ১৩ জুলাই তার পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে মা ও বোনের সাথে সে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। হত্যাকান্ডের দিন সকালে তার পিতার নমিটি হিসেবে তার বোন ও মা ব্যাংকে যাওয়ায় সে ক্ষুদ্ধ হয়ে দুপুরে প্রথমে বোনকে গুলি করে। সেটি লক্ষ্যভ্রস্ট হলে সে দ্বিতীয় গুলিটি করে তার মাকে। গুলিটি তার মায়ের চোখে বিদ্ধ হয়। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মা মারা যায়। সেদিন রাতেই তার বোন শায়লা শারমিন নিপা বাদী হয়ে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পটিয়া থানায় মামলা করেন।
র্যাবের অধিনায়ক এই ঘটনায় শিক্ষা নিয়ে সন্তানদের আরো বেশি সময় দিয়ে মানুষ করার জন্য অভিভাবকদের অনুরোধ করেন।